wild-zone  
 
  Story 05/19/2024 2:03pm (UTC)
   
 
শুরুতেই বলছি এটি একটি কাল্পনিক গল্প।
 
                                                                            ►একটি লাশের আত্মকথা

জীবনটা ভালোই কেটে যাচ্ছে। ২৭ বছরের জীবনেযে এত্তকিছু একসাথে পেয়ে যাব তা আমি বা তন্বী কেউ ভাবিনি।ভাবছেন তন্বীকে? আমার বউ, আমার জীবন সাথী। পড়া লেখা যদিও খুব বেশি একটা করতে পারিনি। কারিগরী বোর্ডের আন্ডারে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা করেছি। তাই কত....! ছোট্ট একটা পরীর মত মেয়ে হয়েছে আমাদের। নামটাও রেখেছি সেই রকম, “লিয়ানা ফাতিহা এইতো সেদিন জুনের তারিখে ছোট্ট একটা বাবু আল্লাহ্ আমাদেরকে দুপুর ৩ টার দিকে দিয়ে গেল।এখন সারাদিন ওকে দেখেই পার হয়ে যায় আমাদের দুজনের। প্রেমের বিয়ে আমাদের।অনেক বাধা-বিপত্তি পার করে আজ আমরা এক সাথে আছি। তাই এখনো দুজন দুজনাকে ছাড়া কিছু বুঝি না।আমার বউতো আমাকে প্রায়ই বলে, “আমাকে একা রেখে মরে গেলে কিন্তু খবর আছে!” শুনে হাসি... তাছাড়া আর কি করব বলেন? মৃত্যুতো আর আমার হাতে নাই।

ছোট খাটো একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি আমি।টুকটাক দিন চলে যায় আর কি।আমার বা তন্বীর কারোই সে রকম কোন উচ্চাকাঙ্কখা নাই।আমরা যে একসাথে আছি এই আনন্দই ৫ বছর ধরে শেষ করতে পারি নি! ২২ বছর বয়সে বিয়ে করে কি বিপদেই না পড়ে ছিলাম! থানা-পুলিশ, পালানো, নির্ঘুম রাত কাটানো....বিশাল উত্তেজনা কর ঘটনা! সে কথা না হয় আর একদিন বলব। বর্তমানে স্ত্রী কন্যা নিয়ে ছোট্টএ কটা দুই রুমের বাসায় বাংলাদেশে যতটুকু শান্তিতে থাকা যায় আছি আর কি। ধুর... যে কথা লিখতে বসলাম তা বাদ দিয়ে কি সব জীবন বৃত্তান্ত বলছি আপনাদের! কিছুমনেকরবেননা।আমিএকটুবাচালপ্রকৃতির (আমারবউএরমতে)!

আমার মেয়েটা খুব লক্ষী। ভাবছেন নিজের সন্তান বলে বলছি? না...না...আপনিও এসে দেখে যেতে পারেন। আজ তার বয়স মাস পূর্ণ হলো। আর এই মাসে সে কখনোই উচ্চ স্বরে কান্না-কাটি, জেদ করেনি। শুধু প্রবলেম একটাই... আমার মত আমার মেয়েও ঘুমাতে চায়না! আমার বউতো বলে যে পুরোই নাকি আমার মত হয়েছে... হাঃ হাঃ হাঃ! বউ আমার খুব লক্ষী.... কখনই আমার কাছে কিছু চায়না! মাঝে মাঝে ভাবি মানুষ এই রকম ও হয়! কিন্তু আসলেই এই রকম না হলে আমার মত ছোট-খাটো ব্যবসায়ী মানুষের কাছে মুষ্কিল হয়ে যেত! দেখেছেন....আবার গল্প ফেঁদে বসেছি! আপনারা মনে হয় অনেকেই লেখা শেষ না করেই চলে গেছেন, তাই না....গেলে যান...অনেক দিনপর ব্যস্ত জীবনেরফাঁকেদুটো কথা বলার সুযোগ পেয়েছি...হেলায় হারাবো কেন?

সকালে প্রতি দিনের মতই বউ এর ডাকে বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভাঙলো! ঘুম আমার খুব প্রিয়।উঠতে চাইছিলাম না... কিন্তু যখন বলল যে বাবুর দুধ শেষ হয়ে গেছে দুধ কিনতে হবে, তখন আর শুয়ে থাকতে পারলাম না।উঠে হাত-মুখ ধুয়ে শার্টটা গায়ে জড়িয়েই বেরিয়ে পড়লাম সাহেব বাজারেরবিস্কুটবিপণীরউদ্দেশ্যে। মেয়ের আমার কপাল মন্দ! মায়ের দুধ পেটে সহ্য হয় না।ডাক্তার বলেছে ল্যাকট্রোজ না কি যেন নাম, টা বেশি। তাই কৌটার দুধ খাওয়াতে হচ্ছে। আর এদিকে এক প্যাকেট দুধ ৪ দিন ও যায়না ঠিক মতো! বলেন তো, আমি স্বল্প আয়ের মানুষ। আমার পক্ষে কি আর ৪০০/৫০০ টাকা খরচ করে ৪ দিন পর পর গুড়ো দুধ কেনা সম্ভব? তাই বলে আবার আমার মেয়েটাকে কেউ ধমক দিয়ে বসবেন না যেন! আমার তো একটাই লক্ষী মেয়ে। করলাম না হয় একটু কষ্ট! বাসা থেকে না খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। একটারিকশা ও পেয়ে গেলাম... রিকশা ওয়ালার সাথে ভাড়া মিটিয়ে উঠে পড়লাম। দোকানে যেয়ে দেখি ৩৪৫ টাকার দুধ ৩৯৫ টাকা হয়ে গেছে! কেমন লাগে বলেন? আসলে আমরা যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের এই দেশে বসবাস করা খুব কঠিন! দুধের প্যাকেটটা নিয়ে দ্রুত বাসায় যেতে হবে। বাবু আমার এতক্ষণে হয়তো ক্ষুধায় অস্থির হয়ে গেছে! সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টের এই চার মাথার মোড়টা সব সময় ব্যস্ত থাকে। তার উপর আবার যমের মত পুরো ঢাকা ধরে ঘুরে বেড়ায় রাজশাহি ভার্সিটির বাস গুলো। আর ট্রাফিক আইন মানা তো দূরের কথা ভাংতেই যেন সবাই ব্যস্ত। যারা দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন।

এখন
তো সকাল... শহরে সবে ব্যস্ত তার শুরু। রাস্তাটা পার হয়েই আবার রিকশা নিতে হবে.... তারপর সোজা বাসা। ডানে-বামে তাকিয়ে রওনা হয়ে গেলাম।হঠাৎ বিকট শব্দে চমকে উঠলাম! চারদিক অন্ধকার হয়ে উঠল! লোকজন চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, “আহ্ হারে! মারা যাচ্ছে! মারা গেল!” আমি তো অবাক....! কে মারা গেল! এইমাত্রই তো সব দেখতে পাচ্ছিলাম! বাবার হাত ধরে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কেউ ব্যস্ত ভাবে কাঁচা বাজারের ব্যাগ নিয়ে দৌড়াচ্ছে, কেউবা আবার অফিস মুখী....কিন্তু চোখের সামনে থেকে অন্ধকারটা সরছেনা কেন? কি হলো? কে মারা যাচ্ছে? আজব তো! হ্যাঁ... এইতো এবার দেখতে পাচ্ছি! কিন্তুঝাপসা! শরীরটাএকবারেহালকালাগছে।উঠে দাঁড়ালাম আমি। মনে হচ্ছে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি! সব লোকজন দেখি এ দিকে ভিড় করে আসছে। সবাই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম হাতে দুধের প্যাকেট নাই! আমার দুধের প্যাকেট কই? দুধের প্যাকেট? এই যে ভাই... আমার বাবুর দুধের প্যাকেটটা দেখেছেন? ‘বায়োমিল-সয়’.... এইমাত্র ৩৯৫ টাকা দিয়ে কিনেছি! ছোট্ট মেয়েটা আমার না খেয়ে বসে আছে! আমি দুধ নিয়ে গেলে তার পর খাবে! প্লিজ....কেউ দেখেছেন কি?

আমার
কাছে তো আর টাকাও নাই! ৫০০ টাকার একটায় নোট ছিলো! এখন কি হবে! মাহফুজের কাছ থেকে আবার ধার নিবো? নাহ্.... তাহলে? আরে.. তো বায়োমিল-সয়ের প্যাকেটটা পড়ে আছে....যাক বাবা... এত্ত ভিড়ের মধ্যেও পাওয়া গেল! কিন্তু একি!!! প্যাকেটটা রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে তো! আর পাশেরক্তাক্ত শরীরটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে!! শার্টটা তো আমারই! স্যান্ডেলআমার মত, যদিও আরেক পার্ট দেখতে পাচ্ছিনা। ধুর... চোখের মাথা খেয়েছি মনে হয়! এটাতো আমারই শরীর! কেমন নিস্থর- রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। মাথার উপর দিয়ে বাসের চাকাটা চলে গেছে! হলুদ হলুদ ঘিলু গুলো চার দিকে ছড়িয়ে গেছে! তাই চেহারাটা চিনতে পারছিলাম না।.... তাহলে আমিই মারা গেছি! অদ্ভুত ব্যাপার! এতক্ষণ টেরই পায়নি! আসলে আগে কখনো মরে দেখিনি তো, তাই অনুভুতিটা জানা ছিলো না। এই ভার্সিটির বাসগুলো আসলেই যে কি!! এত লোকের ভেতর আমাকেই মারতে হবে? আর মারবি তো ভালো কথা আরেক দিন মারিস.... আজনা বাবুর দুধ কিনতে এসেছি? এটা কি ঠিক হলো? এখন নিষ্পাপ বাচ্চাটা কি খাবে??

অবশ্য মরে গিয়ে খুব একটা খারাপ লাগছে না। শরীরটা পাখির পালকের মত হালকা হয়ে গেছে। কেমন যেন কুয়াশার ভেতর আছি আমি। সবাইকে দেখতে পাচ্ছি.... আরে.. আমি এগুলাকিভাবছি? আমারতোবাসায়যেতেহবে। সর্বনাশ.... অনেকক্ষণ হয়ে গেছে.... এই সব অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? লিয়ানা আমার না খেতে পেয়ে হয়তো কাঁদছে। ওর মা তোমনে হয় বাসাতেই ঢুকতে দিবে না! কি যে আছে কপালে! যায় রওনা দিই....আজ হাঁটতে হাঁটতেই যেতে হবে মনে হচ্ছে! যেভিড় বাজারে! লোকজন হুমড়ি খেয়ে আমার লাশটাকে দেখছে.... কয়েক জনতো আবার ভাংচুরশুরু করে দিয়েছে। নাহ্... এখানে আর থাকা যাবেনা। তন্বী শুনলেব কাদিবে। আর আমি তো এখন সন্তানের বাবা... এসবের ভেতর থাকতে নাই। হাঁটা ধরলাম বাড়ির দিকে.... মজার ব্যাপার হলো কেউ আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না! কিন্তু রাস্তার কুকুরগুলো কেমন করে যেন কুঁকড়িয়ে তাকিয়ে আছে।থাকুক... আমার থামলে চলবে না।

বাসার সামনেটা সেই রকমই আছে। লোকজন সব ব্যস্ত। এদিকে কেউ কিছু জানেনা। বাসায় ঢুকতেই ভয় লাগছে।এই থেঁতলানো চেহারা দেখে তন্বী আর বাবু তো ভয় পেয়ে যাবে! তারপরও ঢুকে পড়লাম। আজ আর কলিং বেল টিপতে হলনা। বউ আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা মাঝে মাঝেই ক্ষুধায় কেঁদে উঠছে! আহারে! তন্বীর উদাস চেহারা আর মেয়ের কান্না শুনে আরেক বার মরে যেতে ইচ্ছা হল! ওরা এখনও খবর পায়নি মনে হয়। আমি মেয়েটার কাছে গেলাম, “এই যে মা! বাবা চলে আসছে। কিন্তু আজতো একটু কষ্ট করতে হবে। তোমার দুধেরপ্ যাকেটটা রক্তে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। আরেক প্যাকেট কেনার মত টাকা ও নেই আমার কাছে! সমস্যা নাই আজ আমরা সবাই না খেয়েই থাকবো, কেমন?” তন্বীকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে! কি টের পেয়ে গেছেনা কি! নামনে হয়।

টিং টং... টিং টং.... এই সময় আবার কে আসলো!
আচ্ছা, অর্ক....কি হলো আবার! ছেলেটাকে ভদ্রতা শেখাতেই পারলাম না! কতবার বলেছি কলিং বেল একবার টিপে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। আসলে তো আমাকে ফোন দিয়ে আসে।ছেলেটা এভাবে হাঁপাচ্ছে কেন? ভাবি ভাবি বলে চিৎকার করছে কেন?
দাঁড়া...আজতোরখবরআছে! শালাঅর্ক! তন্বীদরজাখুলতেইহুড়মুড়করেঢুকেপড়ল।
ভাবি, ভাই বাজারে যেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে, হসপিটালে আছে.. আপনি এখনি চলেন।ওরে মিথ্যুক! আমি অসুস্থনা? তোদেরকে আমি মিথ্যা বলা শিখিয়েছি! তন্বী তো শুনেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল! “কি হয়েছে? বল? কি হয়েছে ওর?”
না তেমন কিছু ইহয়নি.. আপনি আগে চলেন।কেমন মিথ্যুক দেখেছেন আপনারা! আমার মাথার উপর দিয়ে বাসের চাকা চলে গেছে আর বলছে কিছু হয়নি!

এদিকে পুলিশ আমার লাশটা সিলেট মেডিকেলে নিয়ে আসলো। সেই চির চেনা পরিবেশ। কতবার যে কত মানুষের জন্য এসেছি। মাত্র তিন মাস আগেই মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে গেলাম এখান থেকে আর এখন নিজেই এসেছি লাশ হয়ে! বউ আমার বা বুকে কোলে নিয়ে ছুটে আসলো। ছোট বাচ্চাটা এখনও বুঝতেই পারে নিযেসে এতিম হয়ে গেছে। বাবা, মা, বোন, চাচা, মামা, শ্বশুর, শ্বাশুড়ী বন্ধুরা অনেকেই এসেছে দেখছি। বাহ্! একসাথে এত পরিচিত মুখ দেখে ভালোই লাগছে। লিয়ানা.... আমার মামনি, ওকে আর একটু কাছেআনছে না কেন? মেয়েটাকে কেমন বিসন্ন দেখাচ্ছে! কি টের পেয়ে গেছেযে ওর বাবা আর নাই! আর বাবার কোলে চড়ে ঘুরতে পারবে না! কি জানি, ছোট বাচ্চারাতো ফেরেস্তার মত, হয়তো সব বুঝতে পারছে। ওদিকে আমার বউ দেখি কাঁদছে! মহামুষ্কিল! তন্বী, ছিঃ! এইভাবে কাঁদতে হয় না। আমি তো তোমাদের ছেড়ে যেতে চায়নি। কিন্ তুআমার কি দোষ বলো? ঘাতক বাসতো আমাকে বাঁচতে দিলনা। তুমি ভেঙে পড়োনা প্লিজ! আমি আর তুমি একসাথে কত বিপদ পার করেছি ভেবে দেখো.... কখনো কি আমাকে হতাশ হতে দেখেছো? তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তা হলে বাবুর কি হবে? তো কেবল তিন মাস। আরও অনেক দিন বাকি আছে... এখন থেকে তো আমি সব সময় তোমাদের সাথে ছায়ার মত থাকতে পারবো।প্ লিজএ কটু শান্ত হও! আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না। সারারাত জেগে থাকবোনা। এখনতো কেয়ামত পর্যন্ত ঘুমিয়েই কাটাতে হবে। তোমার হাতে খাওয়া খুব মিস করবো। তারপর ওকি করবো বলো? এটা কি আমার দোষ? আমি তোমাকে হয়তো ভালো বাসা ছাড়া কোন দিনই দামি দামি শাড়ি গয়না দিতে পারিনি। কিন্তু ভালো বাসার উপরে আর কিছু হয় বলো?

লিয়ানা ফাতিহা.... নামটা আমার দেয়া। আমার একমাত্র সন্তান, আমার সব। মারে, পারলেক্ ষমা করো আমাকে। পিতা হিসাবে তোমার এই ক্ষুদ্র জীবনে যতটুকু সামর্থ্য ছিলো করেছি।আফসোস তোমাকে বড় দেখে যেতে পারলাম না! কত ইচ্ছা ছিলো তোমাকে মানের মত করে মানুষ করব। আমি যা পাইনি তার সব তোমাকে দিব। হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাবো, শপিং করবো, খেলবো, তোমার বিয়ে দিব..... তারা পর নাতি-নাতনির সাথে আনন্দ করে পর পারে যাব। কিন্তু হারামজাদা বাসটা তা হতে দিল নারে মা! এই বয়সে তুমি এতিম হয়ে গেলে! তোমার জীবনটা অনেক কঠিন হয়ে গেল। জীবনেরপ্ রতি পদে আমার অভাব বুঝতে হবে তোমাকে। তাই বলে কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না। অনেকেই আছে যাদের বাবা-মা দুটোই নাই। তোমার তো তাও মা আছে। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। বড় হয়ে মাকে দেখে শুনে রাখতে হবে না? মারতো এখন তুমি ছাড়া আর কেউ থাকলোনা। মাগো, একটাই দোয়া করি তোমার জন্য, সব সময় সত্যকে সত্য বলে জানিও.... মিথ্যার আশ্রয় নিওনা কখনো। তোমার জন্য হয়তো টাকা পয়সা, ধন সম্পত্তি কিছুই রেখে যেতে পারলাম না।কিন্তু তোমার মাকে রেখে গেলাম। মাকে কখনোই অসম্মান করো না। এই মানুষটা তোমার বাবার জন্য সব বিসর্জন দিয়েছে। অনেক কষ্ট তার মনে।

বাবা... আমার বাবা।এ কমাত্ রছেলের লাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। কখনোই আমাদের দুই ভাই-বোনের উপর কোন কিছু চাপিয়ে দেননি এ ই মানুষটা। আমার সব অনিয়ম, অন্যায় আবদার মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন। তারপরও অবুঝ আমি সব সময় তার সাথে উপদেশ গুলো অমান্য করেছি। বাবার ইচ্ছা ছিলো আমি যেন পড়ালেখা করে অনেক বড় হই। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আব্বু, আমার উপর অনেক রাগ করে আছো, তাইনা? তমি আমার কাছে আসছোনা কেন? কাছে এস আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও। তোমার সন্তানকে তো আর বেশিখণ কাছে পাবে না। আমাকে চলে যেতে হবে। তুমি কিবু ঝতে পারছো আমার কথা?

আমার মা, তার কান্না কেউ থামাতে পারছেনা। প্রাইমারী স্কুলের টিচার আমার মা। ছোট থেকেই আমাদের সেরকম সময় দিতে পারেনি। কিন্তু যতক্ষণ কাছে থেকেছে বুকে আগলে রেখেছে। মাগো.... কেঁদে আর লাভ নাই। আমি তো আর ফিরবো না মা।তোমাদের কাছে আমার দুইটা কলিজার টুকরা রেখে গেলাম।পারলেএকটুদেকেরেখো।কতদিনতোমাকেদুঃখদিয়েছি! পারলেক্ষমাকরমা।মাদেরমনতোঅনেক বড়্ক্সমা করবেনা মা?

অর্চি... আমার একমাত্র ছোট বোন।এই পাগলী, তুই এইভাবে কান্নাকাটি করলে হবে? আর সবার মত তুই যদি এরকম করিস তা হলে কেমন হয় বল? তুইনা কত কিছু বুঝিস। একটুথাম আপু।দেখ লিয়ানা তোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে একটু কোলে কেরে আমার কাছে নিয়ে আয়..... আমি যেমন তোকে ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, আমার মেয়েটাকেও একটু দেখিস। তোকে কিন্তু আর্মি অফিসার হতে ইহবে। আর আমি তো চলেই গেলাম...বাবা মাকে তোকেই দেখে রাখতে হবে কিন্তু। বাবা-মার মনে কখনোই কষ্ট দিবি না প্রমিস কর। আমি যে ভুল গুলো করেছি সেগুলা তুই কখনই করবিনা, ঠিক আছে?

বন্ধুদের মধ্যেও অনেকে এসেছে দেখছি।এই শুভ্র, কিশোর, সেলিম, বিশ্ব তোরা বোকার মত দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? কাছে আয় গাধার দল।আমি তো পারছিনা। সোহেরটা আবার আহাম্মকের মত কাঁদছে কেন? ওকে কেউ থামা! আরে গাধা, এইভাবে কাঁদলে কি আমি ফিরে আসবো! আমি আর তোদের কে জ্বালাবো নারে। রুবেল মামা, আপনার সাথে আর গাড়িতে ঘোরাও হবে না। এই শোন, তোদেরকে যদি কোন কষ্ট দিয়ে থাকি মানে রাখিসনা প্লিজ।আর আমার মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রাখিস।

বাবা, আমাকে এখানে ফেলে রেখেছো কেন? আমি বাসায় যাবো। ধুর... এই গন্ধ মেডিকেলে কেউ থাকে। আমাকে প্লিজ বাসায় নিয়ে যাও।আমি শেষ বারের মত আমার বিছানায় আরেকটু ঘুমাতে চাই। পুলিশরা বলছে আমার নাকি পোস্টমর্টেম করবে! কি লাভ বলো বাবা? পোস্টমর্টেম নাকি অনেক কষ্ট হয়। আমাকে নিয়ে চলো। আমিএ খানে থাকবো না।
দুপুরের পর হসপিটালের সমস্ত ফরমালিটি সেরে আমাকেনিয়ে সবাই বাসার উদ্দেশ্যেরও না হলো। কিন্তু বাসার চারপাশে এত্ত ভিড় কেন? ওমা.... এত এত পরিচিত মুখ কিন্তু আমি তো কারও সাথেই কথা বলতে পারছি না। সবাই কি মনে করবে! বাসায় দেখি আত্মীঅ স্বজন ভর্তি। সবার চোখে পানি । কেমন লাগে বলেন আপনারা? এভাবে সবাই মিলে কাঁদলে কি হবে! কত কাজ বাকি এখনো!

কে? জনি ভাই নাকি? এত দেরি হলো কেন? কাজে গেছিলেন? আপনাকেই তো খুজছিলাম এতক্ষণ। আপনার তো বিশাল দায়িত্ব। আমার কবর খুড়তে হবে না? আপনাকে তো আগেই বলে রেখেছি। আর শোনেন, আপনার ভাবির খোজ খবর নিতে ভুলবেন না কিন্তু। মেয়েটাও থাকলো। অবশ্যই সব সময় দেখে রাখবেন। স্কুলে নিয়ে যাবেন.... চিপস কিনে দিবেন..... আর আমারগল্প শোনাবেন। আমার মেয়েটাকে যেন কেউ কষ্ট না দেয়।তানা হলে কিন্তু আপনার খবর আছে। ভুত হয়ে আপনার ঘাড় মট কাবো আমি! আসরের মধ্যে গোসল কমপ্লিট। সাদা কাফনে জড়িয়ে আমাকে এখন বাসার ডাইনিং রেখেছে। সন্ধ্যার একটু আগে আমাকে কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল সবাই। ঠিক আছে, আমি চলে যাবো, কিন্তু আমার মেয়েটা কই? এই তন্বী, মেয়েটাকে আমার কাছে একটু আনো। শেষ বারের মতওকেএকটু ছুঁয়ে দেখবো।কি হলো? কে আছো? আমার মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে আসো! মেয়ে আমার প্রত্যেক দিন বিকালে বাইরে ঘুরতে বের হত আমার সাথে। পাউডার মাখালেই খুশি হয়ে যেত, ভাবতো বাইরে নিয়ে যাব। তিন মাস বয়সেই বাবাকে চিনে ফেলে ছিলো। কত কথা বলতো আমার সাথে... এখন ইমা বলতে পারে।আর কয় দিন পর বাবা বলা ও শিখে যেত। পাকানি হবে একটা! কিন্তু আফসোস মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে পেলাম না!

এইবার মনে হয় আমাকে কবর দেওয়ার জন্য টিকা পাড়া গোরস্থানে নিয়ে যাবে। শেষ বারের মত বাড়িটা ঘুরে দিখলাম।আর কোন দিন তো আসা হবে না! আমাদের ঘর, কম্পিউটার, আমার প্রিয় ল্যাপটপ, ছোট্ট লিয়ানার বিছানা আর ও কত কি! ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে! কি আর করার আছে! যায়.... আর তো থাকা যাবে না। সবাই মিলে খাটিয়ায় তুলে আমাকে নিয়ে গোরস্তানের দিকের ওনা হল। পুরো পাড়ায় কান্নার রোল উঠল নতুন করে।রিয়ন আর বাবা সামনে ধরেছে।শুভ্র আর সোহেল ধরেছে পিছনে। তন্বী, লিয়ানা, অর্চি, আম্মু.... কই তোমরা? আমার কাছে আসো..... শেষ বারের মত আমাকে দেখে যাও। আমি তো আর থাকবো না।আমার মেয়েটাকে আমার কাছে কেউ নিয়ে আসছনা কেন? আমি তো শেষ বারের মত ওকে একবার দেখতে চাই! মাগো...কই তুমি? লিয়ানা.... লিয়ানা..... বাবার কাছে আসো একবার.....তোমার কপালে শেষ বারের মত একটা চুমু দিতে চাই।

মাগরিবের আগে জানাজা শেষ হলো... অনেক দূর দূর থেকে ও অনেকে এসেছে। নামায শেষে বাবা সবার কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল।বাবা অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে! মাগরিবের নামায শেষ হতেই আমাকে কবরে নিয়ে যাওয়া হলো। বাহ্....জনি ভাইতো ভালোই কবর বানিয়েছে। কবর....কেয়ামতের আগে এটাই আমার স্থায়ী ঠিকানা। অদ্ভুতব্ যাপার, তাই না? আমাদের প্রত্যেক কেই কবরে যেতে হবে।কিন্তু আমি মনে হয় একটু আগেই চলে এলাম! কবরে শোয়ানোর পর সবাই তিন মুঠো করে মাটি দিল।আমি অন্ধকারে চাপা পড়ে গেলাম.....অন্ধকার....নিকষ কালো অন্ধকার! সবাই যে যার মতো চলে গেল। কিন্তু বাবা এক কোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে এখনো... বাবা....তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে থেকোনা তো মাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে! প্লিজ চলে যাও....প্লিজ!

কবর সম্পর্কে আগে অনেক ভয় ছিলো! না জানি কেমন লাগবে থাকতে। কিন্তুএখন কি ভয় পেলে চলবে। এখানে তো আর তন্বী ঘুম দিয়ে দিবে না! এটাই এখন আমার স্থায়ী ঠিকানা। অভ্যাস হযে যাবে ধীরে ধীরে....
অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কিছুই করার নাই। একটু পরই হয়তো বিচার শুরু হবে। কিন্তু ভাবছি কি দোষ ছিলো আমার? আল্লাহ্ কেন আমার তিন মাসের মেয়েটাকে এতিম করলো? কেন এত অল্প বয়সে আমার বউকে বিধবা হতে হলো? যে বাবা কোলে পিঠে করে বড় করেছে কেনইবা তার কাঁধে চড়ে কবরে আসতে হলো? আমি কার কাছে এর বিচার চাইবো? হত ভাগী বউ আমার এতিম মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাবে? কি করবে? মেয়ের দুধ কেনার টাকাইবা কোথায় পাবে? মেয়ে আমার কার কাছে বায়না ধরবে? আমার এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কি আপনারা কেউ দিতে পারবেন? কারো কাছে উত্তর আছে? কি হলো? কেউ কথা বলছেন না কেন? আর কত দিন আপনারা চুপ করে থাকবেন? আর কত লিয়ানাকে এভাবে পিতৃ হারা হতে হবে? আর কত তন্বীকেএইভাবে অল্প বয়সে বিধবা হতে হবে? ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে মেয়েটা এখন কোথায় যাবে? আর কত বাবাকে এইভাবে ছেলের লাশ কাঁধে বইতে হবে? আর কত রুবায়েত অদক্ষ চালকের হাতে প্রাণ দিলে আপনারা বুঝবেন? প্লিজ জেগে উঠুন সবাই।আমার মত, আমার সন্তানের মত, আমার পরিবারের মত আর কারো জীবনে যেন এই রকম না হয়। সবাই সোচ্চারহন। আমরা বাঁচতে চাই... এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হতে চাইনা আর.................।।

***
যাদের নাম অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করেছি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। গল্পটি প্রকাশ করলাম। এই গল্পের সকল নাম, চরিত্র এবং স্থানমৃত্যুটা কাল্পনিক। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে সেইটাও বাস্তব হতে কতক্ষণ? এটা শুধুমাত্র একটা গল্প নয়। প্রতিদিন অসংখ্য পরিবার এভাবে অসহায় হযে পড়ছে।আমি আমার নিজের জীবনে দেখা একটি বাস্তব নিয়েই এটা লিখলাম।  প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সড়ক দুরঘটনায় মারা যাচ্ছে। পঙ্গুত্ববরণ করছে আরও অনেকে। আজ হয়তো আমরা খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে এই রকম অনেক খবর দেখছি। কিন্তু যে কোন সময় আমি, আপনি অথবা আপনার আপন কেউ এর শিকার হতে পারেন। আর ভালো লাগলে শুধু লাইক দিয়েই চলে যাবেন না, অবশ্যই একটা কমেন্ট করবেন।  সকলের প্রতি শুভ কামনা রইল।

Tanvir Mahmud                                                                                                
   
22-03-14
                                                                                                              


                                                                                            Please like this page ►

 
  Menu
 
 
 
 
 
 
 
 
 
  Clock
  If u like this web plz like & confirm it

This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free